বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাংবাদিকদের অবদান চিরস্মরণীয়
০৭ডিসেম্বর,শনিবার,নিউজ একাত্তর ডট কম: বহু মুক্তিযুদ্ধ পৃথিবীর বুকে ঘটে গেছে। পরাধীনতা থেকে মুক্তিই যার প্রধান শর্ত। যুদ্ধগুলো ছিল মূলত সবল জাতির বিরুদ্ধে দূর্বল জাতির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে বাঙালী জাতির স্বাধীনতার লড়াই- ই ছিল মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘদিনের শোষণ আর বঞ্চনার ফলশ্রুতি ছিল এই মুক্তিযুদ্ধ। সেদিন বাংলাদেশ বলে পৃথিবীর মানচিত্রে কোনো দেশ ছিল না। আজকের বাংলাদেশ সেদিন পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৪৭ এর ১৪ই আগষ্ট ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে দুটো স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পৃথিবীর বুকে জন্ম নিল ভারতবর্ষ ও পাকিস্তান নাম নিয়ে । পশ্চিম বাংলা রয়ে গেল ভারতবর্ষে আর পূর্ব বাংলা হলো পশ্চিম পাকিস্তানের একটি প্রদেশ , নাম হলো পূর্ব পাকিস্তান।১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজদের অধীনতা থেকে মুক্ত হবার পর সেদিন বাঙালী জীবনে নতুন ভোর আর নতুন বাচার প্রতিশ্রুতি। কিন্তু তা হলো না ১৯৪৭ থেকে আবার শুরু হলো নতুন সংগ্রাম। আবার জন্ম নিল বাংলা মায়ের বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী সন্তান।১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন বুঝতে পেরেছিল, তাদের পরাজয় অনিবার্য তখনই পরিকল্পিতভাবে তারা জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। নবগঠিত এই দেশটি যাতে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে দুর্বল থাকে, কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সেজন্য তারা জাতির সূর্য-সন্তান বুদ্ধিজীবীদের নিধন করার এক কুৎসিত এবং লোমহর্ষক পরিকল্পনা করে। তাদের পরিকল্পনার মূল সহযোগী ছিল আল-বদর বাহিনী। এরাই ১১ ডিসেম্বর থেকে ব্যাপকভাবে বুদ্ধিজীবী নিধন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু করে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দেশীয় দোসরদের সঙ্গে নিয়ে দেশের বরেণ্য সকল শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের চোখ বেঁধে নিজ নিজ বাড়ি থেকে তুলে আনে এবং পৈশাচিক নির্যাতনের পর হত্যা করে। পরিকল্পিত এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞটিই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- নামে পরিচিত। উইকিপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা দেশে ১ হাজার ১শ ১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল। এর ভেতর ১৩ জন ছিলেন সাংবাদিক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যুদ্ধপূর্ব পাকিস্তান শাসনামলে দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, পূর্বদেশ, জনপদ, অবজারভার বাঙালির চেতনাকে যেভাবে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনকে উদ্বুদ্ধ ও ঐকমত্য তৈরিতে ভূমিকা পালন করেছিল তা ইতিহাস হয়ে আছে। পরম শ্রদ্ধেয় তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর আহমেদ চৌধুরী, আহমেদুল কবির, আব্দুস সালাম, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, এম. আর আক্তার মুকুল, রণেশ দাশগুপ্ত, কামাল লোহানী, সন্তোষ গুপ্তসহ নির্ভীক সাংবাদিকদের ভূমিকা আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে আজো মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। জীবন দিতে হয়েছে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে। একদল সাহসী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক দেশের ভেতরে-বাইরে, অবরুদ্ধ রণাঙ্গনে বসে, পালিয়ে, গোপনে, প্রকাশ্যে বের করেন একাধিক সংবাদপত্র। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তান বাহিনীর মর্টারের গোলায় তিনটি দৈনিক পত্রিকার প্রেস ও অফিস ধ্বংস হয়ে যায়। এগুলো হলো দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ ও দ্য পিপল। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বিকেল ৪ টার দিকে ইত্তেফাক অফিসে দুটি ট্যাঙ্ক থেকে গোলা ছুড়ে সেই অফিসটি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। ৩১ মার্চ খুব সকালে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বংশালে অবস্থিত তৎকালীন দৈনিক সংবাদ অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়। তাতে শহীদ হন ওই পত্রিকার এক সময়কার সহকারি সম্পাদক সাংবাদিক এ কে এম শহীদুল্লা। যিনি শহীদ সাবের নামে পরিচিত। তিনি সংবাদ অফিসেই রাত কাটাতেন। অগ্নিদগ্ধ হয়ে তিনি মারা যান।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাংবাদিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন দৈনিক পূর্বদেশ ও জয়বাংলা পত্রিকার সাংবাদিক আবুল মনজুর, চট্টগ্রামের মাসিক বান্ধবী পত্রিকার সাংবাদিক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথিকা পাঠিকা বেগম মুশতারী শফি, দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার সাংবাদিক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথক আবু তোয়াব খান, দৈনিক অবজারভার পত্রিকার সাংবাদিক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের চরমপত্র পাঠক এম.আর. আখতার মুকুল, সাংবাদিক ওয়াহিদুল হক, দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার সাংবাদিক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথক মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ, দৈনিক পূর্বদেশ ও জয়বাংলা পত্রিকার সাংবাদিক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথক রণজিত পাল চৌধুরী, দি পিপলের সাংবাদিক আবিদুর রহমান, দৈনিক ইত্তেফাক ও জয়বাংলা পত্রিকার মোহাম্মদুল্লাহ চৌধুরী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি বিভাগের সংগঠক আলমগীর কবির, খুলনার সাংবাদিক ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের তথ্য কর্মকর্তা আলী তারেক, সাংবাদিক রণেশ দাশ গুপ্ত, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও সাংবাদিক মুছা সাদেক, দৈনিক সংবাদ পত্রিকার আবুল হাসনাত, দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার মহাদেব সাহা, দৈসিক অবজারভার ও জয়বাংলা পত্রিকার এ.বি.এম.মুসা, সাপ্তাহিক হলিডের সাদেক খান, বাংলার বাণীর শফিকুল আজিজ মুকুল ও আমির হোসেন, দৈনিক আজাদ ও জয়বাংলা পত্রিকার আমিনুল হক বাদশা, দৈনিক অবজারভার পত্রিকার মৃণাল কুমার রায় ও জালাল উদ্দিন, দৈনিক বার্তা পত্রিকার আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী, দৈনিক আজাদী পত্রিকার সাধন কুমার ধর, দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকা এবং জয়বাংলা পত্রিকার সম্পাদক আব্দুল গাফফার চৌধুরী, দৈনিক অবজারভার পত্রিকার ফয়েজ আহমেদ, দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার কামাল লোহানী, দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সন্তোষ গুপ্ত, দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার আল মাহমুদ, দি পিপল এর নির্মলেন্দু গুণসহ আরও অনেকে। এসব সাংবাদিকদের প্রায় সবাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে কোন না কোন ভাবে যুক্ত ছিলেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বিশ্বব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে সমর্থন আদায়ে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে সংবাদসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করে। আর এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এক ঝাঁক নির্ভিক সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিল্পীসহ বহু বুদ্ধিজীবী। এ প্রসঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জনপ্রিয় রম্যকথিকা বিষয়ক অনুষ্ঠান চরমপত্র এর কথক ও লেখক সাংবাদিক এম আর আক্তার মুকুল, সংবাদভিত্তিক কথিকা বিশ্ব জনমতের কথক সাংবাদিক সাদেকীন, রম্যকথিকা পিন্ডির প্রলাপ অনুষ্ঠানের কথক আবু তোয়াব খান এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। ফয়েজ আহমদ, মোহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরী, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, কামাল লোহানী প্রমুখ সাংবাদিকরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কামাল লোহানী ছিলেন সংবাদ বিভাগের প্রধান।
মুক্তিযুদ্ধকালীন কতজন সাংবাদিক শহীদ হয়েছিলেন তার সঠিক তথ্য না পাওয়া গেলেও উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছেন, সিরাজুদ্দীন হোসেন, কার্যনিবাহী সম্পাদক দৈনিক ইত্তেফাক (নিহত ১০ ডিসেম্বর), শহীদুল্লাহ কায়সার, সহ- সম্পাদক দৈনিক সংবাদ (নিহত ১৪ ডিসেম্বর), শহীদ সাবের, সহকারী সম্পাদক দৈনিক সংবাদ (নিহত ৩১মার্চ), নিজাম উদ্দিন আহমেদ, জেনারেল ম্যানেজার পি.পি.আই সংবাদদাতা, বিবিসি, (নিহত ১২ ডিসেম্বর), আ.ন.ম গোলাম মোস্তফা, সিনিয়র সম্পাদক দৈনিক পূর্বদেশ, (নিহত ১১ ডিসেম্বর), চিশতি হেলালুর রহমান, বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা দৈনিক আজাদ (নিহত ২৫ মার্চ), সৈয়দ নাজমুল হক, চিফ রিপোর্টার পি.পি.আই সংবাদদাতা, সি.বি.এস (নিহত ১১ ডিসেম্বর), খন্দকার আবু তালেব, সহ-সম্পাদক দৈনিক পয়গাম (নিহত ২৯ মার্চ), শেখ হাবিবুর রহমান, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ঝিনাইদহ প্রেসক্লাব (নিহত ১০ এপ্রিল), আবুল বাশার চৌধুরী, সাংবাদিক দৈনিক মর্নিং নিউজ (নিহত অক্টোবর), আবু সাঈদ, আঞ্চলিক প্রধান দৈনিক আজাদ-রাজশাহী, (নিহত ২৮ জুন), শেখ আব্দুল মান্নান (লাডু) সাংবাদিক দৈনিক অবজারভার, মোহাম্মদ আখতার, কর্মাধ্যক্ষ সাপ্তাহিক লালনা (নিহত ১৪ ডিসেম্বর), সেলিনা আক্তার পারভীন, সম্পাদিকা শিলালিপি (নিহত ১৪ ডিসেম্বর)।
যুদ্ধের নয় মাসে অবরুদ্ধ বাংলাদেশ থেকে ব্যক্তি ও বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে বেশ কিছু পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের মে মাসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচারের আগে এই পত্রিকাগুলোই ছিল যুদ্ধ সংক্রান্ত তথ্যপ্রাপ্তির প্রধান উৎস।
যুদ্ধের শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ৩০ মার্চ উত্তর জনপদের এক মুক্তাঞ্চল নওগাঁ মহকুমা শহর থেকে নিয়মিতভাবে- দৈনিক জয় বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১১ এপ্রিল পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র এই দৈনিকটি প্রকাশিত হয়। ১৪ এপ্রিল নওগাঁ শহরে হানাদার বাহিনী ঢুকে পড়ে। সম্পাদক এদিন ভারত চলে যান। পঞ্চাশের দশকের শেষ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল মাসিক-চিত্রাঙ্গদা। সিলেটের লেখক-সাংবাদিকদের পরিশ্রমের ফসল হিসেবে প্রতি সোমবার প্রকাশিত সাপ্তাহিক-জন্মভূমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জন্মভূমিতে প্রধানত প্রকাশ পেতো মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে প্রতিবেদন, আলোচনা, ব্যাঙ্গ চিত্র, ছবি প্রভৃতি। সাপ্তাহিক- বাংলার বাণী বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা শুরু হলে স্বভাবতই- বাংলার বাণীর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। পরে এই পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণি মুজিবনগর থেকে বাংলার বাণী প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। ৭ এপ্রিল ঠাকুরগাঁও থেকে প্রকাশিত হয় আরও একটি দৈনিক পত্রিকা- দৈনিক বাংলাদেশ। সম্পাদক ছিলেন গাজী মাজহারুল হুদা। মাত্র ছয়টি সংখ্যা প্রকাশের পর এটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে মুক্তাঞ্চল তেতুলিয়া থেকে পত্রিকাটির আর চারটি সংখ্যা (১৮-৩০ জুন) প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপক প্রচার ও বাংলাদেশ সরকারের মুখপত্র হিসেবে ১১ই মে ১৯৭১,জয় বাংলা পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে। সাপ্তাহিক জয়বাংলা ছিল মুজিবনগর সরকারের নিয়মিত রাজনৈতিক মুখপত্র। সম্পাদক ছিলেন মুজিবনগর সরকারের তথ্য দফতরের জনাব আব্দুল মান্নান। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত এই পত্রিকা দেশে-বিদেশে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়। মুক্তিযুদ্বের সময় চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। রণাঙ্গণ ছিল মুক্তিফৌজের সাপ্তাহিক মুখপত্র। সম্পাদক রণদূত। রণদূত সম্পাদকের ছদ্মনাম। ১১ জুলাই থেকে টাঙ্গাইল জেলা মুক্তিফৌজের বেসামরিক দপ্তর থেকে প্রকাশিত। ১৩ জুন থেকে প্রকাশিত হয় স্বাধীন বাংলার সাপ্তাহিক মুখপত্র বঙ্গবাণী। সম্পাদক কে এম হোসেন। ফিরোজ প্রিন্টিং প্রেস নওগাঁ থেকে মুদ্রিত এবং এম এ জলিল কর্তৃক প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালের জুন মাসে ঢাকার রমনা থেকে সাপ্তাহিক বাংলাদেশ একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ২২ জুন থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত পত্রিকাটির ১০টি সংখ্যা পাওয়া যায়। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত হয় সংবাদ নিবন্ধ সাপ্তাহিক বাংলার মুখ। সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান আশরাফী। রঞ্জিত প্রকাশনীর পক্ষে সম্পাদক কর্তৃক পলাশ আর্ট প্রেস, মুজিবনগর, বাংলাদেশ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। স্বাধীন বাংলার সাপ্তাহিক মুখপত্র ছিল স্বাধীন বাংলা। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদিকা মিসেস জাহানারা কামরুজ্জামান। সম্পাদক এসএমএ আল মাহমুদ চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত এবং বলাকা প্রেস, জামানগঞ্জ, রাজশাহী, বাংলাদেশ থেকে এমএ মজিদ কর্তৃক মুদ্রিত। ১৯৭১ সালের ১৬ জুন তারিখে প্রকাশিত হয় জাতীয়তাবাদী সাপ্তাহিক মুখপত্র স্বদেশ। জুলাই মাসে পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে সরকার কবীর খানের সম্পাদনায়, কেজি মোস্তফার সার্বিক তত্ত্বাবধানে মুক্তি বাহিনীর সাপ্তাহিক মুখপত্র- সোনার বাংলা প্রকাশিত হয়। গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশলের খবর সংবলিত পত্রিকা- সাপ্তাহিক বিপ্লবী বাংলাদেশ প্রকাশিত হয় বরিশাল থেকে। রংপুরের রৌমারী মুক্তাঞ্চল থেকে আগস্ট মাসে সাইক্লোস্টাইলে প্রকাশিত হয় স্বাধীন বাংলার মুক্ত অঞ্চলের সাপ্তাহিক মুখপত্র সাপ্তাহিত অগ্রদূত। সম্পাদক আজিজুল হক। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মাসিক সাহিত্যপত্র- মুক্তি শত্রু পরিবেষ্টিত বাংলাদেশ থেকে সাইক্লোস্টাইলে প্রকাশিত হয়। সম্পাদক ছিলেন শরাফউদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাপ্তাহিক মুখপত্র ছিল নতুন বাংলা। বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ) কর্তৃক বাংলাদেশ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। এই পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের খবরসহ আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের ইস্যুকে তুলে ধরার লক্ষ্যে বিভিন্ন নিবন্ধ ছাপা হতো। ২০ সেপ্টেম্বর করিমগঞ্জ থেকে প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সিলেট জেলার নির্ভীক স্বাধীন মুখপত্র সাপ্তাহিক মুক্ত বাংলা। ১৯৭১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর মুজিব নগর ও সিলেট থেকে একযোগে প্রকাশিত হতে থাকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর সাপ্তাহিক বাংলা। সেপ্টেম্বর মাসে মুজিবনগর থেকে মোহাম্মদ জিন্নাত আলীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়,মুক্তিযোদ্ধা ও সংগ্রামী জনতার মুখপত্র- সাপ্তাহিক দাবানল। সেপ্টেম্বরের শেষার্ধে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক প্রতিনিধি। মওলানা ভাসানীর অনুসারী আব্দুর রহমান সিদ্দিকীর সম্পাদনায় ১৮ অক্টোবর প্রকাশিত হয়,বাংলাদেশের মুখপত্র। মুক্ত বাংলা নামের একটি পত্রিকা বাংলাদেশের কোনো এক স্থান থেকে প্রকাশিত এক পাতার ক্ষুদে পত্রিকা। মুক্তিফৌজের সাপ্তাহিক মুখপত্র হিসেকে জাগ্রত বাংলা প্রকাশিত হত। ময়মনসিংহ জেলা ও উত্তর ঢাকার বেসামরিক দপ্তর আসাদনগর (ডাকাতিয়া) থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত। রংপুর থেকে- রণাঙ্গন নামে আরও একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। সাপ্তাহিক বাংলাদেশ নামে একটি পত্রিকা তড়িৎ সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত হতো। কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির চট্টগ্রাম বিভাগের পাক্ষিক মুখপত্র হিসেবে স্বাধীন বাংলা প্রকাশিত হতো। বাংলাদেশের জনযুদ্ধের মুখপত্র- হিসেবে ১৯৭১ সালের ২৭ অক্টোবর ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় দেশবাংলা। নভেম্বর মাসে সিলেট অঞ্চল থেকে তুষার কান্তি করের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়- সংগ্রামী বাংলার কণ্ঠস্বর,সাপ্তাহিক দুর্জয় বাংলা। খোন্দকার শামসুল আলম দুদুর সম্পাদনায় সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতার সাপ্তাহিক মুখপত্র- সাপ্তাহিক স্বাধীন বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এছাড়া নোয়াখালী থেকে সাপ্তাহিক আমার দেশ, তেঁতুলিয়া থেকে সাপ্তাহিক সংগ্রামী বাংলা, ঢাকা থেকে সাপ্তাহিক অভিযান, লন্ডন থেকে বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিক্রমা, বাংলাদেশ নিউজ লেটার, পাক্ষিক বাংলাদেশ টুডে, ও সাপ্তাহিক জনমত, অ্যামেরিকা থেকে বাংলাদেশ পত্র, শিখা, স্ফুলিঙ্গ, বাংলাদেশ নিউজ লেটার, বাংলাদেশ ওয়েস্ট কাস্ট নিউজ বুলেটিন প্রকাশিত হতো। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বাংলাদেশ মিশন বহির্বিশ্ব প্রচার দফতর কর্তৃক মুজিবনগর বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয় ইংরেজি পত্রিকা সাপ্তাহিক বাংলাদেশ। পত্রিকাটি ১৯৭১ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত নিয়মিত প্রকাশিত হতো। ১৯৭১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত হয়,বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের মুখপত্র- ইংরেজি পাক্ষিক দি ন্যাশন। মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক উত্তাল পদ্মা। এসএম ইকবাল, মিন্টু বসু, হেলাল উদ্দিনের সম্পাদনায় অনিয়মিত অর্ধ-সাপ্তাহিক বাংলাদেশে ১৭ এপ্রিল বরিশাল থেকে প্রকাশিত হয়। ভারতের গৌহাটি থেকে প্রকাশিত হয় মুক্তি। দি পিপল নামের একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশিত হয় আবিদুর রহমান এর সম্পাদনায়। স্বাধীন বাংলা-সোনার দেশ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো রাজশাহী থেকে। এসব পত্রিকা ছাড়াও আরো অনেক পত্র-পত্রিকা মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকাশিত হয়েছে। এসব পত্র-পত্রিকার উদ্দেশ্য একটাই ছিল,বাংলাদেশকে পরাধীনতা মুক্ত করা। এসব পত্র-পত্রিকায় যেসব সাংবাদিকরা কাজ করেছেন তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ মাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের খবর সংগ্রহ করতে চলে গেছেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে। সংগ্রহ করেছেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পৈশাচিকতার ছবিও। তারপর সেগুলো পত্রিকায় প্রকাশ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সৃষ্টি করতেন জনমত।
গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি সেইসব সাংবাদিকদের যারা বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন।
লেখকঃ মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন চৌধুরী, সাংবাদিক,কলামিষ্ট ,সম্পাদক নিউজ একাত্তর ডট কম ও চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান,দৈনিক আজকের বিজনেস বাংলাদেশ ।